Barrackpore History in Bengali(ব্যারাকপুরের ইতিহাস)

ঝটিকা সফরে ঐতিহাসিক শহরে

ব্যারাকপুর পশ্চিমবঙ্গের  এক সুপ্রাচীন শহর।  ব্যারাকপুরকে সাধারণত শিল্প নগর  বলা হয় কিন্তু এই নগরের নামের সাথে জড়িয়ে আছে বাংলা তথা ভারতের ইতিহাস। জড়িয়ে আছে সেই প্রাচীন লাটসাহেবের বাংলো, এশিয়ার প্রথম চিড়িয়াখানা, বিখ্যাত ঘোড়দৌড়ের বিলুপ্ত ইতিহাস। যে মাটিতে ইংরেজরা  তাদের  ভারী বুটের আস্ফালন দেখিয়েছিল। সিপাহী মঙ্গল পান্ডে যে আস্ফালন সহ্য করতে পারেননি। মহিয়সী নারী লর্ড ক্যানিংয়ের ভালোবাসার শহর ছিল এই ব্যারাকপুর। শহরটি  উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার গঙ্গা তীরবর্তী এক মহকুমা শহর। ভারতবর্ষের ইতিহাসে ব্যারাকপুরের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। এই শহরেই দেশের প্রাচীনতম  বিমানঘাঁটি রয়েছে।  রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ, জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী, সীমান্ত গান্ধী বাদশা খান, ও ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেবের পদধুলিমাখা শহর হল ব্যারাকপুর।

 ব্যারাকপুরের ইতিহাস :

ব্যারাকপুরের ইতিহাস জানা থাকলে আমার ধারণা এই সুপ্রাচীন ঐতিহাসিক শহর ভ্রমণের আনন্দ লাভ করা যাবে। তাই আমি প্রথমে আমি ব্যারাকপুরের ইতিহাসকে সংক্ষিপ্ত আকারে একটু ধরার চেষ্টা করছি।

ব্যারাকপুরের একসময় নাম ছিল “চানক”। ১৪৯৫ সালে বিপ্রদাস পিপিলাই রচিত “মনসামঙ্গল কাব্যে” এই “চানক” নামটা প্রথম পাওয়া যায়।  ১৮৭১ সালে কবি দীনবন্ধু মিত্র তাঁর “সুরধূনী” কাব্যেও “চানক”  নামটি ব্যবহার করেছিলেন। পরবর্তীকালে ১৭৭২ সালে ব্রিটিশ সৈন্যরা এখানে ব্যারাক অর্থাৎ সেনা ছাউনি তৈরী করে, সেই সময় ব্যারাক শব্দটি থেকেই চানক নামটা পরিবর্তিত হয়ে ব্যারাকপুর নামে পরিচিতি লাভ করে। কারো কারো মতে ব্যারাকপুর একসময় সপ্তগ্রাম পরগনার অধীনে ছিল।  সেই সময় এখানকার শাসনকর্তা ছিলেন রুকউদ্দিন বারবক শাহ। তাঁর স্মৃতিকে  স্মরণ করে লোকে  চানককে বরাবকপুর বলত। পরে অপভ্রংশ হয়ে ব্যারাকপুর হয়।   ১৭৬৫ সাল নাগাদ ব্রিটিশরা ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্ট তৈরী করেছিল।

২৫৪ বছর পূর্বে ব্যারাকপুরে যে ক্যান্টনমেন্ট তৈরী হয়েছিল সেটাই ভারতবর্ষের ৬২টা ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে সর্বপ্রথম ক্যান্টনমেন্ট ছিল। ১৮৫৭ সালের ২৯শে মার্চ ব্রিটিশ অবিচারের বিরুদ্ধে ব্যারাকপুরে বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল। দাঁত দিয়ে কার্তুজ কাটা নিয়ে অসন্তোষের স্ফুলিঙ্গ ছড়াতে শুরু হয়। এই স্ফুলিঙ্গের আগুন জ্বলতে জ্বলতে এক মহাবিদ্রোহের রূপ নেয়। এখানকার সিপাহীরা  প্রতিবাদে গর্জে ওঠে।  এই বিদ্রোহের নেতৃত্বে ছিলেন ৩৪ নং রেজিমেন্টের ৫নং কোম্পানির সিপাহী মঙ্গল পান্ডে (সিপাহী নং ১৪৪৬)। ৩৪ নং রেজিমেন্টের দেশীয় বাহিনীর সার্জেন্ট মেজর হিউসন সাহেব জমাদার ঈশ্বরী পান্ডেকে হুকুম করেছিলেন বিদ্রোহী সিপাহীদের বন্দী করার জন্য।  ঈশ্বরী পান্ডে সেই হুকুম পালন করেননি। মঙ্গল পান্ডে সেই সময় লুকিয়ে হিউসন সাহেবকে লক্ষ্য করে বিদ্রোহের প্রথম গুলিটি চালিয়েছিলেন। যদিও গুলিটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিল। এই খবর পেয়ে ওই রেজিমেন্টের লেফটেনান্ট বি  এইচ বগ ঘোড়ায় চড়ে প্যারেড গ্রাউন্ডে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। মঙ্গল পান্ডে তাকে লক্ষ্য করে দ্বিতীয় গুলি চালিয়েছিলেন। বগ ঘোড়া সমেত মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন। মাটি থেকে উঠে তিনি  মঙ্গল পান্ডেকে গুলি করেছিলেন, কিন্তু সেই গুলিও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিল। মঙ্গল পান্ডের  ভাই মাতাদিন  বাল্মীকি, ঈশ্বরী পান্ডের সাথে আরো বেশ কিছু সিপাহী এই মহাবিদ্রোহে সক্রিয়ভাবে এই অংশগ্রহণ করেছিল। এইভাবে বেশ কিছুক্ষন প্যারেড গ্রাউন্ডে বন্দুক ও তরোয়ালের লড়াই চলেছিল। বেগতিক দেখে মঙ্গল পান্ডে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তিনি সফল হতে পারেননি। তিনি ধরা পরে  গিয়েছিলেন।  ঈশ্বরী পান্ডেকেও সেইসময় ধরা হয়েছিল। অবশেষে ৮ই এপ্রিল ১৮৫৭ সালে মঙ্গল পান্ডে ও তাঁর ভাই মাতাদিন বাল্মীকিকে এখানকার ধোবি ঘাটে  ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল।

ব্যারাকপুর লাটভবন :
কলকাতার লাটভবনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তৈরী করা হয়েছিল ব্যারাকপুরের লাটভবনটিকে।  ১৮০১ সালে  লর্ড ওয়েলেসলি এই বিশাল  বাড়িটি  নির্মাণ শুরু করেছিলেন। বাড়িটি নির্মাণ করার জন্য প্রচুর অর্থ খরচ হওয়ার জন্য বোর্ড অফ ডিরেক্টরস ওয়েলেসলিকে দেশে ফেরত পাঠাবার ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। ১৮০৫ সালে ওয়েলেসলি বাড়িটি  অসমাপ্ত রেখে দেশে ফিরে  গিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে যত গভর্নর এখানে এসেছিলেন সকলেই এই লাটভবন ও ব্যারাকপুর পার্কের উন্নতিসাধন করেছিলেন। সেই পার্কই আজকের মঙ্গল পান্ডে পার্ক।

এশিয়ার প্রথম চিড়িয়াখানা :
যখন বোর্ড অফ ডিরেক্টরস ওয়েলেসলিকে দেশে ফেরাবার জন্য করার ব্যবস্থা করছে, তখন ওয়েলেসলি একজন পরিবেশপ্রেমী হিসেবে নিজেকে তুলে ধরার চেষ্টা করছিলেন।  তারই ফল স্বরূপ তিনি ১৮০০ সালে ব্যারাকপুরে তিনি এক পশুশালা তৈরী করেন। যেটা ব্যারাকপুর চিড়িয়াখানা নামে প্রসিদ্ধ লাভ করেছিল। এই  চিড়িয়াখানায়  বাঘ, সিংহ, হরিণ, ভালুক, বানর, ক্যাঙ্গারু, গন্ডার ও  উট এইসব পশু ছিল বলে শোনা যায়। পরবর্তীকালে আলিপুর চিড়িয়াখানা তৈরী হওয়ার পর এইসব পশু ওখান থেকে আলিপুর চিড়িয়াখানায় স্থানান্তরিত করা হয়।

বিখ্যাত ঘোড়দৌড় :
১৮০৬ সালে ব্যারাকপুরে ঘোড়দৌড় শুরু হয়েছিল। ঘোড়  দৌড়ের মাঠ  সেই সময় জমজমাট ছিল।কলকাতা থেকেও জনপ্রিয় ছিল এই ঘোড় দৌড়। সেই সময় তৈরী করা হয়েছিল একটা নতুন স্টেডিয়াম। কলকাতা থেকে ঘোড়দৌড় দেখতে আসার সুবিধার জন্য ১৮২৭ সাল নাগাদ রেল লাইন পাতা হয়েছিল। সেনানিবাসের ভিতরেই একটা রেলওয়ে স্টেশনও তৈরী করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে অবশ্য এই ঘোড়দৌড় বন্ধ হয়ে যায়।

ব্যারাকপুরের ইতিহাসের গল্পতো মোটামুটি জানালাম এবার আমার ঘোরার কথায় আসি। গত বছর লক্ষ্মী পুজোর পরের রবিবারে ফেসবুকের “সহযোগী” নামের  একটা গ্রুপের বিজয়া উপলক্ষে দুপুরে  এক মিলন উৎসব ব্যারাকপুরের গঙ্গার পাড়ের একটা বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই গ্রুপের কর্মকর্তা শ্রী বিশ্বজিৎ গুপ্তর অনুরোধে আমায় ওই অনুষ্ঠানে যোগদান করতে হয়েছিল। অনুষ্ঠানে যোগদানের আগে ও পরে আমি ব্যারাকপুরের কিছু দর্শনীয় স্থান ঘুরে নিয়েছিলাম। আজ সেইসব জায়গার কথা আপনাদের জানাব। ব্যারাকপুরের সব দর্শনীয় স্থানই  ইতিহাসের ছোঁয়ায় সমৃদ্ধ।  তা সে  আঠারো – উনিশ শতকের ইতিহাস হোক বা বিংশ শতাব্দীর ইতিহাস হোক। ইতিহাসকে বাদ  দিয়ে এই  শহরের কথা বলা সম্ভব নয়। আমি শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে ব্যারাকপুর স্টেশনে এসে নামলাম।

ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে ১৮৬২ সালে শিয়ালদহ থেকে অধুনা বাংলাদেশের কুষ্টিয়া পর্যন্ত রেল লাইন পেতেছিল। ব্যারাকপুর স্টেশনটা সেই সময়ই চালু করা হয়েছিল। ১৮৬২ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর ব্যারাকপুরের উপর দিয়ে প্রথম ট্রেন চলেছিল। স্টেশনটা আজ দেখতে দেখতে  ১৫০ টা  বছর অতিক্রম করে ফেলেছে। স্টেশনটা সত্যিই দর্শনীয়। শুধু দর্শনীয় নয়, খুবই সুন্দর। পুরোনো আমলের বাড়ি, দেখলাম স্টেশনটিকে খুব সুন্দরভাবে রক্ষনাবেক্ষন করা হয়। স্টেশনের বাইরে রয়েছে অটো, টোটো ও রিক্সা স্ট্যান্ড রয়েছে। স্টেশন চত্বরেই একদিকে কয়েকটি লস্যির দোকান আর একদিকে ফার্স্ট ফুডের দোকান আছে।  এই স্ট্যান্ড থেকে একটু এগোলে হরেক রকমের দোকান আছে , তার মধ্যে মন হরণ করা বেশ কিছু খাবারের দোকানও রয়েছে দেখলাম। ব্যারাকপুরের বিখ্যাত দাদা-বৌদির বিরিয়ানির দোকানটাও একবার ভালো করে দেখে নিলাম। এইসব খাবারের দোকানের দিকে না তাকিয়ে মনটাকে  শক্ত করে আমি অটো স্ট্যান্ডে ফিরে এলাম। অন্নপূর্ণা মন্দির দর্শনের জন্য এখান থেকে একটা অটো রিক্সা ধরে প্রথমে তালপুকুরে এসে নামলাম।

শিবশক্তি অন্নপূর্ণা মন্দির :

অন্নপূর্ণা মন্দির

এক মন্দিরটি খুবই প্রাচীন এক মন্দির। মন্দিরটি রানী রাসমণির কনিষ্ঠা কন্যা জগদম্বা দেবী ১৮৭৫ সালে তৈরী করেছিলেন। মন্দিরটি  অবিকল দক্ষিনেশ্বরের ভবতারিণী মন্দিরের আদলে তৈরী। এই মন্দিরে দেবী অন্নপূর্ণা প্রতিষ্ঠিত আছেন। এছাড়া মহাদেবও গর্ভগৃহে বিরাজ করছেন। মন্দিরটির পিছনদিকে ৬ খানা ছোট আকারের শিবমন্দির রয়েছে। একটা সুন্দর নাটমন্দির ও নহবৎখানাও রয়েছে। মন্দিরের পিছনের দ্বার দিয়ে গঙ্গার ঘাটে যাওয়ার রাস্তা রয়েছে। ঘাটটিও খুব সুন্দর করে বাঁধানো। ঘাটটির নাম “রাসমনি ঘাট”। ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেব চারবার এই মন্দির দর্শনে এসেছিলেন।  ঠাকুরের পদধূলিমাখা মন্দিরটি খুবই সুন্দর। এটি বঙ্গীয় স্থাপত্য শৈলীতে তৈরী নবরত্ন মন্দির। এখানে বেশ শান্ত  ও নিরিবিলি পরিবেশ বজায় রয়েছে। মন্দিরটিতে ঢোকার জন্য একটা বিশাল প্রবেশদ্বার রয়েছে। প্রবেশদ্বারের উপরে একটা বিশাল সিংহের মূর্তি রয়েছে। মন্দিরটি দর্শনার্থীদের জন্য সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২.৩০ ও বিকেল ৪টা  থেকে রাত্রি ৮টা খোলা রাখা হয়। এখানে কিছুটা সময় কাটাতে মন্দ লাগলো না। তবে  দক্ষিনেশ্বরের মন্দিরের পরিবেশের সাথে এখানকার পরিবেশের  আসমান-জমিন ফারাক রয়েছে।

জগন্নাথ মন্দির

জগন্নাথ মন্দির:  অন্নপূর্ণা মন্দির যাওয়ার পথে সুন্দর উজ্জ্বল কমলা রঙের একটা মন্দির দেখতে পেলাম। এই মন্দিরটি প্রভু জগন্নাথদেবের মন্দির। মন্দিরটির কারুকার্য খুবই আকর্ষণীয়। মন্দিরটির গেটের উপরে দেবী লক্ষ্মী ও বিষ্ণুর মূর্তি আর নীচের দিকে বিষ্ণুর দশাবতার মূর্তি স্থাপিত রয়েছে।  মন্দিরটির ভিতরে একটা নাটমন্দির ও গর্ভগৃহ রয়েছে। গর্ভগৃহে প্রভু জগন্নাথদেবের সাথে বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তিও  রয়েছে ।

শতবর্ষ অতিক্রান্ত  ব্যারাকপুর পুরসভা :
রিক্সা করে যেতে যেতে পথে পড়ল ব্যারাকপুরের আর এক ইতিহাসের সাক্ষর ব্যারাকপুর পুরভবন। এটা কোনো দ্রষ্টব্যস্থান নয়, তবে অবশ্যই  এক ঐতিহ্যপূর্ণ স্থান।নবাবী আমলে ব্যারাকপুর ছিল সপ্তগ্রামের অধীন। ১৭৯১ সালে ইংরেজরা এখানে জমি কেনেন।  ১৮৬৯ সালে ব্যারাকপুরে দুটি  পৌরসভা (উত্তর ও দক্ষিণ) গঠিত হয়েছিল।  পরবর্তীকালে সাউথ ব্যারাকপুর পৌরসভা ভেঙে খড়দহ, পানিহাটি, টিটাগড় পৌরসভা গঠিত হয়েছিল। ১৯১৬ সালের ১লা এপ্রিল ব্যারাকপুর পুরসভা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, যা আজ শতবর্ষ অতিক্রম করে গেছে। রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় জন্মগ্রহণ করলেও ব্যারাকপুরের মণিরামপুরে তাঁর পৈতৃক বাসভবনে দীর্ঘদিন বাস করেছিলেন। তিনি প্রায় ৩৪ বছর উত্তর ব্যারাকপুর পুরসভার পুরপ্রধান ছিলেন। তিনি ১লা মে ১৯৮৯ সাল থেকে ১৫ই  অক্টবর, ১৯২১ সাল পর্যন্ত পুরপ্রধান ছিলেন। তারপর তাঁর পুত্র ভবশঙ্কর ব্যানার্জী ৫ই জুন ১৯২২ সাল থেকে ৩রা নভেম্বর ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত এখানে পুরপ্রধান হিসেবে কাজ করেছিলেন। ১৯২৫ সালের ৬ই আগস্ট রাষ্ট্রগুরু ব্যারাকপুরেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। সেই কারণে ব্যারাকপুর পুরসভা খুবই ঐতিহ্যপূর্ণ এক পুরসভা।

বার্থোলোমিউ চার্চ : 
এই চার্চটি তৈরী করা হয়েছিল আঠারো শতকে। ১৮৩১ সালে চার্চটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছিল। ১৯৫৬ সালের ২৬শে আগস্ট ব্যারাকপুর ডায়োসিস আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।  সেই সময় রোনাল্ড উইনস্টন ব্রায়ান বিশপরূপে এখানে  নিযুক্ত হন। তিনি চার্চটির প্রভূত উন্নতি করেন।  সেই সময় থেকেই এই চার্চটি ক্যাথিড্রাল চার্চ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। পরবর্তীকালে এখানে ব্রিটিশ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা থাকত। চার্চটি ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্ট অঞ্চলে অবস্থিত। চার্চটির স্তাপত্যটিও  বেশ সুন্দর।

গান্ধী ঘাট :

গান্ধী ঘাটের প্রবেশদ্বার

জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতিবিজড়িত ঘাট হল এই গান্ধী ঘাট। যখন রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ গুরুতর  অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, তখন মহাত্মা গান্ধী তাঁকে দেখতে ১৯২৫ সালের ৬ই মে ব্যারাকপুরে আসেন। ১৯৪৮ সালের ৩০শে  জানুয়ারী যখন মহাত্মা গান্ধী নিহত হন, তখন শাস্ত্র অনুযায়ী ভারতবর্ষের বিভিন্ন নদীতে তাঁর চিতাভস্ম অর্পণ করা হয়েছিল। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল চক্রবর্তী রাজা গোপালাচারী এই ঘাটে জাতির জনকের চিতাভস্ম অর্পণ করেছিলেন। ১৯৪৯ সালের ১৫ই জানুয়ারী তদকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু এই ঘাটটির উদ্বোধন করেন। এখানকার দ্রষ্টব্য হল ক্যান্টিলিভার প্রজেকশন, মণ্ডপ ও বিখ্যাত ভাস্কর  সুনীল পালের তৈরী গান্ধী জীবন নিয়ে পোড়ামাটির আলেখ্যটি। ঢোকার মুখেই একটা সুন্দর দ্বার রয়েছে।  দ্বার দিয়ে প্রবেশ করার পর একটু এগোলেই

গান্ধী ঘাট

গঙ্গার তীরে বেশ সুন্দর একটা মিনার করা আছে।  মিনারটির  সাথে আড়াআড়িভাবে একটা বেশ প্রশস্থ ছাদ রয়েছে।  মিনারটির থেকে ধাপে ধাপে গঙ্গায় যাওয়ার সিঁড়ি নেমে গেছে।  মিনারটি ও সামনের দ্বার দুটিই শ্বেত শুভ্র রঙে রাঙানো রয়েছে।  এই সুন্দর পরিবেশে বসে গঙ্গার মনোরম হাওয়া খেতে বেশ ভালো লাগলো। এখানে কিছুক্ষন বসে এবার জওহরলাল নেহেরুর নামাঙ্কিত পার্কটি দেখতে গেলাম।

জওহরকুঞ্জ  পার্ক :
এই পার্কটি গান্ধী ঘাটের পাশেই অবস্থিত। তিরিশ টাকা টিকিটের মিনিময়ে পার্কটিতে  ঢুকতে হলো। গঙ্গার একদম পাশে ছোট বড় নানারকম গাছে সজ্জিত পার্কটি বেশ নিরিবিলি। পার্কটির ভিতরে একটা ছোট পুকুর আছে। কোথাও উঁচু,  কোথাও নীচু এইভাবে রাস্তাটিকে তৈরী করা হয়েছে।  ভিতরে একটা পাহাড়ি পরিবেশ তৈরী করার চেষ্টা করা হয়েছে। পার্কটিতে কয়েকটা ছাউনি দেওয়া বসার জায়গা রয়েছে। গঙ্গার ধারে এই রকম একটা বসার জায়গা পেয়ে গেলাম। নদীর মৃদু-মন্দ স্নিগ্ধ হাওয়া আর সাথে পাখিদের কলতানে  কিছুক্ষন বিশ্রাম করে নিলাম। পরিবেশটা বেশ ভালোই লাগছিল। এর পর মঙ্গল পান্ডের নামাঙ্কিত উদ্যানে যাবো।

মঙ্গল পান্ডে উদ্যান :
মঙ্গল পান্ডে উদ্যানটি ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্ট অঞ্চলে অবস্থিত। এই উদ্যানে ঢোকার জন্য প্রত্যেকের জন্য ১৫ টাকা আর ক্যামেরার জন্য ৫০ টাকা দিতে হয়।  আমি কড়কড়ে ৬৫টা টাকা গচ্চা দিয়ে উদ্যানটিতে ঢুকলাম। উদ্যানটি  সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যে ৬.৩০ পর্যন্ত খোলা থাকে। ভ্রমণার্থীদের  জন্য একদম আদর্শ জায়গা।  উদ্যানটি বেশ সুন্দর।  পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে কিছুটা সময় কাটানোর জন্য খুব ভালো জায়গা। উদ্যানটির  মধ্যে কয়েকটি খাবারের স্টলও আছে। একটা বেশ বড় প্রবেশদ্বার দিয়ে ভিতরে ঢুকে দেখলাম বেশ খোলা মেলা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জায়গাটা। উদ্যানের পুরো রাস্তাটি খুব সুন্দর করে বাঁধানো রয়েছে। এই রাস্তা দিয়ে একটু এগোতেই দেখলাম মঙ্গল পান্ডের একটা মূর্তি বসানো আছে। এক জায়গায় দেখলাম দুটি জিরাফের মূর্তি আর এক জায়গায় দেখলাম বাচ্ছাদের জন্য স্লিপ, দোলনা ও আরো কয়েক রকম খেলনা আছে।  দোলনার উল্টোদিকে একটা কামান রাখা আছে।  গঙ্গার ধার বরাবর বেশ কয়েকটা চেয়ার পাতা রয়েছে।  ওই চেয়ারে  বসে কিছুক্ষন সময় কাটানো খুব স্বাদ ছিল, কিন্তু পূরণ হলো না।  সবকটা চেয়ারই  যুবক-যুবতীরা দখল করে রেখেছে। যাইহোক সবুজে মোড়া এক অসাধারণ উদ্যান দেখলাম, মন ভরে গেল।

গান্ধী স্মারক সংগ্রহশালা :
ব্যারাকপুর রিভার সাইড রোডে একদম গঙ্গার ধারে প্রায় আট-নয় বিঘা জায়গা নিয়ে সংগ্রহশালাটি তৈরী করা হয়েছে।  ১৯৬৬ সালের ৭ই মে এটির উদ্বোধন করা হয়েছিল। গান্ধীজি সম্পর্কিত প্রায় হাজার খানেক আলোকচিত্র, বেশ কিছু চিঠিপত্র আছে। সংগ্রহশালাটিতে পাঁচটি কক্ষ রয়েছে। একটি কক্ষে বেশ বড় একটা দেওয়াল চিত্র রয়েছে, একটি কক্ষে গান্ধীজির জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনাকে আলোকচিত্রের মাধ্যমে তুলে  ধরা হয়েছে, একটি কক্ষে গান্ধীজির ব্যৱহৃত বেশ কিছু সামগ্রী রয়েছে, একটি কক্ষে সুন্দর একটা গ্রন্থাগার আছে আর একটা কক্ষে বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য আলোকচিত্র রয়েছে দেখলাম। সংগ্রহশালাটি বেশ ফাঁকা। এখানকার এক কর্মচারী বললেন রবিবার সাধারণত একটু ফাঁকা থাকে, অন্যান্য দিন স্কুল -কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের ভিড় থাকে। রবিবার সাধারণত বাইরের দর্শনার্থীরা আসে।

যখন মানুষ রোজকার জীবনের যাতাকলে হাঁপিয়ে  ওঠে, তখন সে একটু মনের খোরাক খুঁজতে চায়।  মানুষভেদে মনের খোরাক বিভিন্ন হয়, তবুও বলবো এখানে একদিনের জন্য ঘুরতে  আসলে আপনার মন  অবশ্যই আনন্দে ভরে উঠবে, বিদ্রোহী সিপাহীদের জন্য  শ্রদ্ধায় মাথা নত  হবে।

কিভাবে যাবেন : 
শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ব্যারাকপুরগামী ট্রেন ধরে সোজা ব্যারাকপুর স্টেশনে এসে নামুন।  স্টেশনের বাইরে অটো, টোটো ও রিকশার স্ট্যান্ড রয়েছে।  এই স্ট্যান্ড থেকে শহরের সবকটা  দ্রষ্টব্যস্থানগুলো ঘোরার  জন্য অটো বা অন্য কোনো গাড়ি ভাড়া করে নিন।  ভাড়া মোটামুটি ৩০০ থেকে ৪০০ টাকার মতো লাগবে। এছাড়া কলকাতা থেকে ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড ধরে সড়কপথেও ব্যারাকপুর আসা যায়।

কোথায় থাকবেন :
যদিও কলকাতা থেকে এখানে ঘোরার জন্য রাত্রিবাসের কোনো প্রয়োজন নেই, তবুও আপনি যদি এখানে রাত্রিবাস করতে চান তাহলে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের  মালঞ্চ অতিথি নিবাসে থাকতে পারেন। এই অতিথি নিবাসটি কলকাতা থেকে বুক করতে হবে।

তারিখ : ১৪-০৫-২০১৯

ছবি ও লেখার স্বত্ব : সুদীপ্ত মুখার্জী

যোগাযোগ : ৯৮৩০৪২০৭৫০

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top