Barrackpore and Mangal Pande(মঙ্গল পাণ্ডে ও ব্যারাকপুর)

ইতিহাসের সিপাহী বিদ্রোহ একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ বিদ্রোহ পরবর্তীতে ভারতকে স্বাধীনতার দিকে ধাবিত করেছিল। উপনিবেশবাদী বৃটিশদের অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে ভারত উপমহাদেশে সর্বপ্রথম প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিলেন মঙ্গল পান্ডে। তিনি ভারতীয়দের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম মুক্তিযোদ্ধা ও বীর শহীদ।

মঙ্গল পান্ডের জন্ম ১৮২৭ সালের ১৯ জুলাই। উত্তরপ্রদেশের বালিয়া জেলায় নাগওয়া গ্রামে। অনেকের মতে তার জন্ম হয়েছিল ফৈজাবাদ জেলার সুরহুর গ্রামের একটি ব্রাহ্মণ পরিবারে। দিবাকর পান্ডের ঘরে। পড়াশোনার হাতেখড়ি পরিবারে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পড়াশোনা শেষ করে মাত্র ২২ বছর বয়সে ১৮৪৯ সালে তিনি বৃটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানিতে সিপাহী পদে চাকরি নেন। এখানে চাকরি করতে এসে তিনি অনেকরকম বৈষম্য আর অন্যায় দেখতে পান, যা মঙ্গল পান্ডেকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। ভারতীয় সিপাহীরা যখন কর্মরত থাকতেন, তখন কোনো ইংরেজ সিপাহী বা অফিসার দেখলেই অস্ত্র উত্তোলন করে সম্মান দেখানোর রীতি ছিল। কিন্তু ভারতীয় সিপাহী বা অফিসারকে ইংরেজ সিপাহীরা সম্মান দেখাতো না বরং বিমাতাসুলভ আচরণ করতো। ভারতীয় সিপাহীরা যদি কোনো স্থানে কোনো কারণে মারা যেতেন, তাহলে ওই পরিবারের কোনো খোঁজ-খবর ইংরেজ বাহাদুররা নিতো না। অবশেষে ওই পরিবারটি নিঃস্ব হয়ে যেত। আর ইংরেজ সিপাহীদের ক্ষেত্রে ছিল অফুরন্ত সুযোগ-সুবিধা।

১৮৫৩ সালে তৈরি করা হয়েছিল ৫৫৭ ক্যালিবার এনফিল্ড (পি/৫৩) রাইফেল। এই রাইফেল ভারতীয় সিপাহীদের হাতে তুলে দেয় বৃটিশ সরকার। রাইফেলগুলোর কার্তুজ গরু ও শুকরের চর্বি দিয়ে তৈরি হতো। সৈন্যরা তাদের রাইফেলের কার্তুজ লোড করার সময় তা দাঁত দিয়ে খুলে লাগাতে হতো। গরু ও শুকরের চর্বি মুখে দেওয়া হিন্দু-মুসলিম সৈন্যদের জন্য অধার্মিক ও গর্হিত কাজ। ১৮৫৭ সালের ফেব্রæয়ারিতে সিপাহীরা (বৃটিশ সেনাবাহিনীতে ভারতীয় সৈন্য) নতুন কার্তুজ ব্যবহার করতে অস্বীকার করেছিল। এর প্রেক্ষিতে নতুন কার্তুজ প্রতিস্থাপন করার প্রতিশ্রæতিও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সিপাহীদের কাছে এই প্রতিশ্রæতির কোনো মানে দাঁড়াল না।

এ অগ্নেয়াস্ত্র তুলে দেওয়ার জন্য বৃটিশ শোসকগোষ্ঠীকে চরম মূল্য দিতে হয়েছিল। সম্মুখীন হতে হয়েছিল সিপাহী বিপ্লবের। আর এই বিপ্লবের শুরুটা করেছিলেন মঙ্গল পান্ডে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসে অন্যতম নক্ষত্র হলেন মঙ্গল পান্ডে।

ব্যারাকপুর। কলকাতার একটি অঞ্চল। ব্যারাকপুরের পঞ্চম ব্যাটালিয়নের বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য ছিলেন মঙ্গল পান্ডে। ১৮৫৭ সাল। ইংরেজকে সরাসরি প্রতিরোধের বছর। যাকে আমরা বলি সিপাহী বিদ্রোহ বা যুদ্ধ। কেউ কেউ মহাবিদ্রোহ বলে থাকেন। মহাবিদ্রোহ ১৮৫৭ কে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন রূপে গণ্য করা হয়। ইংরেজ ইতিহাস গবেষকরা একে সিপাহী বিদ্রোহ বলেছেন। ইংরেজ সেনাবাহিনীর অন্তর্গত ভারতীয় সিপাহীরা ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে মূল ভূমিকা পালন করেন। ইংরেজ সরকার এই বিদ্রোহকে কঠোর হস্তে দমন করলেও এর মাধ্যমে ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা হয়। কত লাঞ্ছনা, কত অত্যাচার, কত অশ্রæমোচন, কত নির্যাতন! দীর্ঘ একশত বছর পর অনন্তকাল সমুদ্রের বুকে একটা সাইক্লোন! এটাকে অনেকে আবেগের সাথে পলাশীর প্রতিশোধও বলে থাকেন। মাকে শান্ত করে দিল এই সাইক্লোন। মায়ের সন্তানরা সজীব হয়ে উঠল। ফিরে পেল আস্থা। নেমে পড়ল দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করার জন্য। ণড়ঁৎ ঊহমষরংয ঃুৎধহঃং ধৎব ভবি রহ হঁসনবৎ, সঁৎফবৎ ঃযবস! ধ্বংস কর অত্যাচারী শ্বেতাঙ্গদের। বজ্রগর্ভ এই সঙ্কেত পৌঁছে গেল জনে জনে, নগরে নগরে, গ্রামে গ্রামে।

উঠ, ভারতবাসী জাগো! হিসেব নিকেশের দিন এলো। একশ বছরের নির্যাতনে জর্জরিত মুমূর্ষু মা মুক্তির বেদনায় কাঁদছে। দিনটি ছিল ২৯ শে মার্চ, ১৮৫৭। রবিবার অপরাহ্ন। ব্যারাকপুরের প্যারেড ময়দানে অসময়ে মানুষদের ভিড় বাড়ছে। ৩৪ নং ইনফ্যানট্টির সিপাহীরা দলে দলে জটলা করছে। চাপা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে চারদিকে। সিপাহীদের মধ্যে কেউ এসেছে খালি হাতে, কেউ বন্দুক নিয়ে। সৈনিকদের ভিড় ক্রমেই বাড়ছে। রচিত হবে এক মহান ইতিহাস। মঙ্গল পান্ডে সমস্ত সৈনিকদের প্যারেডগ্রাউন্ডে ডাকেন ও সেখান থেকে সিপাহী বিদ্রোহের ডাক দেন। তার উচ্চ পদাধিকারী তাকে আক্রমণ করলে তিনি তলোয়ার দিয়ে ধড় থেকে মুÐু আলাদা করে দেন।

লাইন থেকে পঞ্চাশ কিংবা ষাট হাত দূরে মঙ্গল পান্ডে। বন্দুক কাঁধে নিয়ে টহল দিচ্ছেন। সবাই তার দিকে তাকিয়ে কানাকানি। লোকটা কি পাগল হলো! কিসের জন্যে তার পাগলামি? সে আজ কি করতে যাচ্ছে। এর ফলাফল বা পরিণাম কি হবে, তারা জানে না। সবাই শুধু গভীর আগ্রহে তার দিকে তাকাচ্ছে। ছয়ফুট দীর্ঘ দেহ। ধীরস্থির প্রকৃতির। নিজের স্বভাবের গুণে সকলের কাছে দারুণ জনপ্রিয় পান্ডেকে কে না চেনে। সেই প্রতিদিনের পরিচিত মঙ্গল পান্ডে কি আজ এক নতুন মূর্তি নিয়ে দেখা দিয়েছেন। এ যেন পান্ডের এক নতুন ছবি। কে জানে, তাকে কোন দেবতা ভর করেছে। চিবুক আকাশের দিক তুলে গুলিভর্তি বন্দুক হাতে সামনে পেছনে পায়চারি করছে। হঠাৎ তী² চিৎকার। বেরিয়ে এসো ভাইসব। ফিরিঙ্গির পায়ের তলায় আর কত দিন থাকবে! ওরা আমাদের সোনার দেশ, গর্বের মাতৃভূমি লুটেপুটে যাচ্ছে। আর আমরা মরছি অনাহারে। ওরা আমাদের বেঁচে থাকার অস্তিত্বে হাত দিয়েছে। আমাদের করেছে জাতিভ্রষ্ট। ভাইসব এসব ফিরিঙ্গিদের মারো। কি অদ্ভুদ এই উম্মাদনা! কি এর নাম! মূর্খ সিপাহী কি তা কি জানে! এর নাম দেশপ্রেম। মাতৃভূমি রক্ষার উম্মাদনা। পান্ডেকে শায়েস্তা করার জন্য লেফটেন্যান্ট এলো। কিন্তু পান্ডে স্থির ও অবিচল। বন্দুকের নল লেফটেন্যান্টের দিকে সোজা তাক করে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে পান্ডে। লেফটেন্যান্টের ঘোড়াটি সরাসরি পান্ডের গায়ের ওপর চড়িয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে পান্ডে গুলি চালাল। ঘোড়াটি মাঠে লুটিয়ে পড়ল। লেফটেন্যান্ট পান্ডেকে লক্ষ্য করে গুলি চালাল। কিন্তু ওই গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। পান্ডে একটু এগিয়ে গিয়ে তলোয়ার দিয়ে লেফটেন্যান্ট বগকে সলিল সমাধি ঘটল। লেফটেন্যান্টের পরে এসেছিল সার্জেন্ট। সার্জেন্ট পান্ডের তলোয়ারের কাছে ধরাশায়ী হলো। তারপর আসল পল্টু। সে ইংরেজদের দালাল। মঙ্গল পান্ডেকে পেছন থেকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে। পল্টুও রক্ষা পেল না পান্ডের ধারালো তরবারির কাছে। নিজেকে মুক্ত করল পান্ডে। সবাই উত্তেজিত। সিপাহীদের মধ্যে উল্লাসধ্বনি। শেষ বিকেলে বিদ্রোহের সংবাদ পেয়ে সেনাপতি হিয়ার্সে চলে আসল সেনাক্যাম্পে। ততক্ষণে মঙ্গল পান্ডে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তারপরও তিনি বৃটিশদের হাতে মরবেন না বলে মনে মনে সিদ্ধন্ত গ্রহণ করেন। হঠাৎ পান্ডের পিস্তল গর্জে ওঠে। অভিমানী সৈনিক। আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে। নিজের মাথায় ঠেকিয়ে দেয় পিস্তল। গুলি ফসকে গেল। ধোঁয়া, বারুদ ও অগ্নিশিখার মধ্যে আহত রক্তাক্ত দেহ লুটিয়ে পড়ল। ধরে ফেলল পান্ডেকে। তাকে চিকিৎসা করল বৃটিশ সরকার। উদ্দেশ্য সুস্থ্য করে নির্মম শাস্তি দেওয়া।

৬ এপ্রিল সেপাই মঙ্গল পান্ডের বিচার। বিচারের নামে প্রহসনমাত্র। মঙ্গল পান্ডে তখনো অসুস্থ, হাসপালে শুয়ে। ক্ষতস্থানগুলো ফুলে ওঠেছে। বাঁচার আশা নেই বললেই চলে। ৮ এপ্রিল সকাল। অসুস্থ মুমূর্ষু সৈনিক মঙ্গল পান্ডেকে ব্যারাকপুরে সমস্ত সৈনিকদের সামনে ফাঁসিরকাষ্ঠে ঝুলিয়ে আদেশ কার্যকর করে ইংরেজ। ওই দিন ঈশ্বর পান্ডেকেও ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। কারণ তিনি মঙ্গল পান্ডেকে গ্রেফতার করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। সামরিক আদালতের রায়ে ১৮ এপ্রিল মৃত্যুদÐ কার্যকরের নির্দেশ দেওয়া থাকলেও নির্ধারিত সময়ের ১০ দিন আগে তাকে হত্যা করা হয়। প্রকৃতপক্ষে এ বিদ্রোহ সুশৃঙ্খল যেমন ছিল না তেমনি ছিল না সুসংগঠিতও। কেন্দ্রীয় যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে বিদ্রোহ সফল হতে পারেনি। এ ঘটনা সারা ভারতবর্ষের সিপাহীদের মধ্যে প্রবল সাড়া জাগিয়েছিল। সিপাহী মঙ্গল পান্ডের আত্মদানে উজ্জীবিত ভারতীয় সিপাহীরা সংঘবদ্ধভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সেনানিবাসে ব্যারাকে আক্রমণকারীর ভূমিকায় সশস্ত্র বিদ্রোহ সংঘটিত করেছিল। মীরাট, দিল্লি, এলাহাবাদ, অযোধ্যা, লক্ষেèৗ, কানপুর, ঝাঁসী, বারানসী, পাঙ্গনা, কেবলী ইত্যাদি স্থানে সিপাহী বিদ্রোহ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। এমনকি এটা দেশজুড়ে চরম উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল। চট্টগ্রাম ও ঢাকার প্রতিরোধ এবং সিলেট, যশোর, রংপুর, পাবনা ও দিনাজপুরের খন্ড যুদ্ধ তার প্রমাণ বহন করে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top